Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

উপজেলার ঐতিহ্য

                                                                          চলনবিল
চলনবিলের সাতকাহন

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল। এই বিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিলপাড়ের মানুষের জীবন। চলনবিলের মৎস্য সম্পদ যেমন তাদের জীবিকার অন্যতম উৎস। আবার বানের পানিতে দু’কূল ভাসানো বন্যায় এ বিলই আবার তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। পাবনা,নাটোর,সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে প্রায় ৮’শ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে চলনবিল অবস্থিত। বিলের পানি চলমান বলেই এই বিলের নামকরণ হয়েছে চলনবিল। যদিও কথিত আছে চলন দেবী নামে এক সুন্দরী মহিলা ছিল এই এলাকায়। তিনি তার দুই সন্তান নন্দ আর কুশাকে নিয়ে নৌকায় বিল পাড়ি দিচ্ছিল কিন্তু ঢেউয়ের তোরে ডুবে যায় নৌকা। মৃত্যু হয় চলনদেবী আর তার দুই সন্তানের। সেই থেকে এই বিলের নাম চলনবিল। বাংলাদেশে চলনবিলের মতো এতবড় আয়তনের আর কোন বিল নেই। অতীতে এ বিল অনেক গভীর ও বিপদসঙ্কুল ছিল। পানি আর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলের মানুষকে টিকে থাকতে হতো। ক্রমে ক্রমে পলি জমে বিলটি ভরাট হয়ে পড়েছে এবং বহু গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড়াল,আত্রাই, নন্দকুজা, গুমানী, করতোয়া, ভদ্রাবতী,বেশানী,গুড় প্রভৃতি নদী চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। চলনবিলের নামকরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা যায়নি। তবে দুই হাজার বছর আগেও চলনবিলে জলময় কোন উঁচু ভূ-ভাগ ছিল না। তখন চলনবিল মুলতঃ সমুদ্রেরই অংশ ছিল। খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের কোন কোন অংশে পানি জমে ভূমি জেগে ওঠায় সেখানে কিছু কিছু লোক বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে সমুদ্র দূরে সরে পড়ায় চলনবিল অঞ্চল জন্ম লাভ করে। বিখ্যাত চায়নিজ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায়,সপ্তম শতাব্দীতে চলনবিল অঞ্চল পদ্মা ও যমুনা নদী গর্ভে ছিল। কারণ তিনি তৎকালীন পুন্ড্রবর্ধন (বগুড়া মহাস্থানগড়) থেকে বিরাট নদী অতিক্রম করে আমামের কামরুপে (কামরুপ কামাক্ষা) পৌঁছে ছিলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে টলেমির বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যা ম্যাপ অনুযায়ী উত্তরে মহাস্থানগড়,দক্ষিণ-পূর্বে বিক্রমপুর (ঢাকা) আর চট্রগ্রাম দেখা যায়। পদ্মা ও ব্রক্ষপুত্র নদীর মধ্যবর্তী কোন স্থান দেখা যায় না। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় চলনবিল অঞ্চল তৎকালীন গঙ্গা  ব্রক্ষপুত্রের অংশ ছিল। ক্রমে পলি জমে এই বিশাল বিল এলাকা জেগে ওঠে। শুরু হয় নতুন নতুন গ্রাম ও জনপদের গড়ে ওঠা। মাত্র ১’শ বছর আগেও চলনবিলের জলময় অংশের সীমা ছিল ৫’শ মাইলের উপরে। ধীরে ধীরে পদ্মা,আত্রাই ও যমুনার নদীগুলোতে পলি জমি এর আয়তন কমতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ভূমি এবং জনবসতি। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়,চলনবিলের রাজশাহী অঞ্চলের আয়তন ছিল ২’শ ১০ বর্গমাইল এবং পাবনা অংশের আয়তন ছিল ৩’শ ৪০ বর্গমাইল। অর্থাৎ বৃহত্তর চলনবিলের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল। প্রাচীনকালে চলনবিল অঞ্চলে কলেরা ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব বেশী ছিল। কলেরায় গ্রামের পর গ্রামের লোকজন মরে বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছে। আবার ম্যালেরিয়ার কারণে চলনবিল এলাকার মানুষ ছিল শীর্ণকায় ও পেটমোটা। যোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। বিলের উন্মাতাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার প্রয়োজনে গড়ে তুলেছে নতুন নতুন জনপদ। এর ওপরে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে  ১৮৯৭ সালের ১২ জুন চলনবিল অঞ্চলের উপর প্রচন্ড ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভুমিকম্পের ফলে বহু স্থানে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। এর ফলে চলনবিলের কোন কোন নিম্নাঞ্চল উুঁচু হয়ে ওঠে আবার অনেক উুঁচু স্থান নিম্ন জলাভূমিতে পরিনত হয়। এ অবস্থাতেও চলনবিলে ৫/১০ হাত পর্যন্ত পানি থাকতো। বারো মাসই চলনবিলে বিভিন্ন পাল তোলা নৌকা চলতো। কিন্তু চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর কারণে প্রতি বছর পলি জমি  বিল ভরাট হয়ে উঠতে থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি বছর ২২২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করে। অপরদিকে ৫৩ ঘনফুট পলি নদীপথে বিলের সীমা ত্যাগ করে। অবশিষ্ট ১৬৯.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রতিবছর বিলে স্থিতি পায়। এ পলি জমে প্রতিবছর চলনবিল অঞ্চলের ভূমি ০.৫ ইঞ্চি পরিমাণ উুঁচু হয়। ১৯০৯ সালের চলনবিলের তদন্তকারী কমিটির বিবরণ থেকে জানা যায়,তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারাবছর পানি থাকতো। বর্তমানে সারাবছর পানি জমে থাকে এমন স্থান ২০ বর্গমাইলের অধিক হবে না। বিলের অধিকাংশ এলাকা আবাদযোগ্য জমিতে পরিনত হয়েছে। এসব জমিতে ধান,গম,সরিষাসহ নানা প্রকার ফসল উৎপাদিত হচ্ছে।

চলনবিলের প্রাচীন অবস্থান 
প্রাচীনকালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকুমার তিন চতুর্থাংশ,নওগা মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা এবং পাবনা জেলার চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া,ফরিদপুর ও বেড়া থানা এলাকা জুড়ে চলনবিল বিস্তৃত ছিল। এছাড়া বগুড়া জেলার দক্ষিণাংশের কিছু এলাকা চলনবিলের অংশ ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু বিল ভরাটের কারণে প্রতিনিয়ত কমে যায় চলনবিলের আয়তন। পরিবর্তন ঘটে এর মানচিত্রের।

চলনবিলের হালের অবন্থান
বর্তমানে পাবনা জেলার চাটমোহর,ফরিদপুর,বেড়া উপজেলা । নাটোর জেলার সিংড়া,বড়াইগ্রাম,গুরুদাপুর উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ,রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া  উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়ে চলনবিল অবস্থিত।
সিমা- চলনবিলের উত্তরে বগুড়া,দক্ষিণে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলা পূর্বে সিংড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন। পশ্চিমে নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা অবস্থিত।
ভৌগলিক অবস্থান- চলনবিল বিষুব রেখার ২৪০৭ থেকে ২৪০৩৫ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০১০ থেকে ৮৯০৩৫ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। চলনবিলের আয়তন প্রায় ৮’শ বর্গমাইল।

অতীতে চলনবিল
আগে চলনবিল এলাকার অধিবাসীদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বসবাস করতে হতো। লোকালয় ছিল অনেক দুরে দুরে। চারদিকে পানি বেষ্ঠিত অবস্থায় দ্বীপের মতো গ্রামগুলোকে সারা বছর প্রাকৃতিক ঝড়,বন্যা মোকাবেলা করে বাঁচতে হতো। ১২ মাসই তাদের নৌকা করে চলাচল করতে হতো। বর্ষাকালে চলনবিলের গভীরতা আরও বেড়ে যেতো। নৌপথে বিল পাড়ি দিতে গিয়ে ঢেউয়ের কবলে পড়ে অনেক স্থানে নৌকাডুবি ঘটতো। মারা যেতো বহু মানুষ। তাছাড়া দস্যু ডাকাত দলের ভয়তো ছিলই। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সওদাগরদের সহায় সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতো ডাকাত দল। মাছে ভরপুর চলনবিলে আবাদযোগ্য জমির অভাব ছিল। কিছু জমিতে চাষাবাদ হলেও বন্যা ও ঢেউয়ের আঘাতে ফসলহানি ঘটতো। যার ফলে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেই চলনবিল পাড়ের মানুষদের টিকে থাকতে হতো। এখানে ডাঙ্গায় বাঘ,বণ্য শুকর,জংলি মহিষ,বিষাক্ত সাপ এবং পানিতে কুমির.বাইসাল প্রভৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলনবিলবাসীদের বেঁচে থাকতে হতো। চলনবিলের বিস্তীর্ণ উঁচু ভূমিতে ফাকা পড়ে থাকতো অনেক জমি। এসব উঁচু ভূমি মুলতঃ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এ সময় এ সমস্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জন্য তৎকালীন রাজা জমিদাররা অন্য অঞ্চল থেকে লোকজন এনে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। জঙ্গল কেটে স্থাপন করা হয় নতুন নতুন বসতি। ফলে জঙ্গলের পাশে বসতিতে মশার কামড়ে মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। এ কারণে তখন চলনবিলের মানুষ শীর্ণকায় ও পেটমোটা ছিল। বর্ষা মৌসুমে বিলের পানি বাড়ার সাথে সাথে উঁচু ভুমি কমে আসতো তখন বাঘ,সাপ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী লোকালয়ে এসে আশ্রয় নিতো। ফলে প্রতি বছর সাপের কামড়ে এ এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের মৃত্যু ঘটতো। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ও স্বাস্থ্য সচেতন না হওয়ায় কলেরা ও ডায়রিয়ায় হাজার হাজার মনুষের মৃত্যু হতো। তারপরও সোনা ফলা চলনবিলের মাটিতে ফসল হতো ভালো। তাছাড়া প্রতি বছর পলি জমে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়তো। প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো চলনবিলে। বড় বড়  চলনবিলের শামুক ও ঝিনুক থেকে সংগ্রহ করা হতো বড় বড় মুক্তা। চলনবিলে ১২ মাস পানি থাকায় গড়ে ওঠেনি তেমন কোন সড়কপথ। ফলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কিছু কিছু হাট-বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

আজকের চলনবিল
পাকিস্তান শাসন আমল থেকে চলনবিল অঞ্চলে সীমিত আকারে রাস্তাঘাট নির্মাণশুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর এ অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন জোরদার হয়। নতুন নতুন স্কুল কলেজ স্থাপিত হয়। শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ,রাস্তা-ঘাট,ব্রিজ,কালভার্ট প্রভৃতি নির্মাণের মাধ্যমে মাধ্যমে চলনবিল অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতে শুরু করে। প্রতিটি উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ সম্পন্ন হয়েছে। চলনবিলের বুক চিরে সড়ক নির্মিত হওয়ায় অনেক অঞ্চলে বাস চলাচল করছে। অনেক দূর্গম এলাকায় বিদ্যুত সুবিধা পৌছে গেছে। ১৯৭৭ সালে চলনবিল অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৮ হাজা টাকা ব্যয়ে ২৫১ মাইল দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, ১৮৭ মাইল পানি নিস্কাশন খাল, ২৪ টি রেগুলেটর, ৫৮ টি ফ্লাসিং আউটলেট ও ইনলেট,৫৫ টি ব্রিজ,কালভার্ট, ১৩২ টি ভবন নির্মাণ এবং ৯ হাজার ২’শ একর জমি হুকুম দখল করা হয়। প্রকৌশলীরা আশা করেছিলেন এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ হাজার একর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে মাত্র ৫০ ভাগ কাজ শেষ করে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অপরিকল্পিতভাবে কিছু অংশে বাঁধ ও রেগুলেটর নির্মিত হলেও চলনবিলবাসী এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। প্রতি বছর বন্যার বাঁধ ভেঙ্গে হাজার হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে যায়। অপরদিকে একই বাঁধের এক অংশের লোক বন্যা নিয়ন্ত্রণ সুবিধা পেলেও অন্য অংশের ফসল ডুবে যায়। এ কারণে চলনবিলবাসী প্রতিনিয়ত দূর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০০১ সালে চলনবিলের বুক চিরে দীর্ঘ ৫৫ কিলোমিটার হাটিকুমরুল-বনপাড়া সড়ক নির্মিত হয়। ফলে ঢাকার সংগে বিলপাড়ের মানুষদের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। সড়কের কারণে চলনবিলের কৃষকরা সহজেই তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ এবং উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছে। তা সত্ত্বেও চলনবিলের সিংহ ভাগ এলাকা এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ সমস্ত এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বিদ্যুত সুবিধা আজও পৌছেনি। তার উপর প্রতি বছর অতিবর্ষণ,শিলাবৃষ্টির কারণে চলনবিলবাসী কমবেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। চলনবিল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চলনবিলবাসীকে অতিবর্ষণ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যেতো।

চলনবিলে প্রকৃতির খেয়াল
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে খরা ও বন্যার কারণে সৃষ্ট দূর্ভিক্ষ চলনবিলবাসীকে আঘাত হানে। সে বছর চলনবিল এলাকায় ফসল উৎপাদিত হয়নি। ফলে এ অঞ্চলের মানুষদের দূর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৮৮ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় চলনবিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে বছর চলনবিলে তিন-চতুর্থাংশ বাড়ী ঘরে বানের পানি ঢুকে পড়ে। হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে পড়ে। এ অঞ্চলে রোপা ও বোনা আমন ধান তলিয়ে যায়। ১৯৯১ সালে প্রচন্ড শিলাবৃষ্টিতে চলনবিল এলাকার হাজার হাজার একর উঠতি ইরি বোরো ধান ঝরে পড়ে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় রোপা ও বোনা আমন ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সর্বশেষ ২০০৩ সালে সালে বন্যায় চাটমোহর,তাড়াশ,সিংড়া,রায়গঞ্জ এবং উল্লাপাড়া উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলের মানুষ প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে চলনবিলের অনেক উর্বর মাটি থাকা সত্ত্বেও বন্যা,ঝড়,শিলাবৃষ্টির কাছে বারংবার হাড় মানতে হয় চলনবিলপাড়ের মানুষদের। সহায় সম্বল হারিয়ে অনেকেই হয়ে পড়ে নিঃস্ব-রিক্ত।

চলনবিলের শস্য সম্পদ
প্রাকৃতিকভাবেই চলনবিলের মাটি ভীষণ উর্বর। তার উপর প্রতি বছর পলি জমে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ফলে চলনবিল অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। সেই কারণেই উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার বলা হয় চলনবিলকে। বর্ষার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে চলনবিলের নিম্নাঞ্চলে দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষ শুরু হয়। মাটির উর্বরা শক্তির কারণে একবিঘা জমিতে ২০ থেকে ৩৫ মণ পর্যন্ত ইরি ধান উৎপাদিত হয়। পানির কারণে অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা যায়না। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে প্রচুর পরিমাণে গম,সরিষা, তিল,রসুন, আদা, পেয়াজ,ভট্টাসহ নানাবিধ ফসল উৎপদিত হচ্ছে। কয়েক বছর যাবত গুরুদাসপুর,বড়াইগ্রাম ও চাটমোহরে (আংশিক) বিপুল পরিমাণ রসুন উৎপাদিত হচ্ছে।

চলনবিলের মৎস্য ভান্ডার
চলনবিলে রয়েছে এক বিশাল মাছের ভান্ডার। চলনবিলের মাছের কদর দেশ জুড়ে রয়েছে।  চলনবিলের বিস্তীর্ণ হাওড়, খাল, বিল, নদীনালায় ইলিশ, কৈ, মাগুর, শিং, টাকি, বোয়াল, শোল, চিতল, ফলই,রুই,মৃগেল,চিংড়ি,টেংরা,মৌসি,কালিবাউশ, রিটা, গজার, নান্দিনা, শৌল, মধু পাপদা, রানী চিতল, বাইন, চেলা,বাতাসী, বাঁশপাতা, ঘৈরা, ফাঁসী, মোয়া, মৌমি, রায়েক, এলং, ঘাইরা, চান্দা, নোদাই, দাঁইত পুটি, বৌ,সরপুটি, তিতপুটি,পুঁটি, গুজা,গাগর,বাঘাইর কাঁটা প্রভৃতি জাতের বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয় চলনবিলে। প্রতিবছর বর্ষার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে চলনবিলপাড়ের শত শত মানুষ চলনবিলের মিঠা পানির মাছ শিকার করে। অনেকেই জাল,বড়শি ও বাঁশের তৈরী নানারকম মাছ ধরার ফাঁদ বানায়। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র  জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ মাছ মেরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। চলনবিলের মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। মাছের সিজনে তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বিশ্বরোডে প্রতিদিন মাছের হাট বসে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি হয় এই হাটে। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় এই মাছের হাট। ট্রাকে করে মাছ চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চলনবিলের এ সকল মাছের মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

চলনবিলের পাখি
চলনবিলের বালিহাঁস, তিরমূল, বাটুলে, মুরগীহাঁস, খয়রা, মানিক জোড়, ডুটরা, চা-পাখি, লোহাড়াং, মেমারু, বোতক, নলকাক, ফেফী, ডাইক, চখা, বকধেনু, ইচাবক, করা, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিল, মাছরাঙ্গা, কাউর,চাকলাসহ প্রভৃতি পাখি পাওয়া যেত। মানুষ হাত দিয়েই পাখি ধরতে পারত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নাকি শুধু পাখি শিকারের জন্য কয়েকবার এ বিলে এসেছেন। এখন সবই কল্পনার বিষয়।

এবং ইত্যাদি
কুমির, শুশুক, বাইসাল, সাপ, হিংস্র মহিষ, শুকর, কচছপ, ঝিনুক, শামুক,জোঁকসহ হাজারো জীব বৈচিত্রের অঞ্চল হচ্ছে চলনবিল অঞ্চল। এছাড়া নানা জাতের জলজ ফল এক সময় চলনবিলের ভান্ডার পরিপূর্ণ ছিল।   চলনবিলের পনসা ফল ছিল পাক-ভারতে বিখ্যাত। অতীতে এখানে প্রচুর পরিমাণে পদ্মচাকা,মাখনা, শিঙ্গট, নিঙ্গট,ঢ্যাপ, শালুক, সিঙ্গরার প্রভৃতি সুস্বাদু জলজ ফল জন্মাতো। এসবই এখন কেবলই অতীত।

চলনবিলের অধিবাসী
চলনবিল অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিরাট একাংশ হচ্ছে আদিবাসী, জেলে, মুচি পরিবারসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি। তারা অত্যন্ত অসচেতন, নিঃশেষিত, অত্যাচারিত এবং সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে অনেকে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছে চলনবিল অঞ্চলে।

চলনবিলের পরিবেশ সমস্যা
চলনবিল এলাকার পানি সম্পদ, কৃষি সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও জলের অভ্যন্তরীন যে জীব বৈচিত্র সে সকল সম্পদসহ কোন সম্পদের সাথেই পরিবেশ বান্ধব আচরণ করা হচ্ছে না, ফলে চলনবিলের সার্বিক সংকট ক্রমেই জাতীয় সংকটকে স্পর্শ করছে বলে মনে করা যথেষ্ট কারণ আছে। কৃষিতেও সার, কীটনাশকসহ পরিবেশ বৈরী দ্রব্যাদি ব্যবহার হচ্ছে, ফলে কৃষিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি চলনবিলাঞ্চলে বর্তমানে আবাদ হচ্ছে তামাকের। চলনবিলের মাঝখান দিয়ে কিলোমিটার বিশ্বরোড নির্মাণ করার পর থেকে চলনবিলকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবাদী জমি ভরাট করে করে গড়ে উঠছে বসতি। তৈরী হচ্ছে মিল, কল-কারখানা, মার্কেট।

চলনবিলের মানুষের যাপিত জীবন
বর্ষা মৌসুমে পানি নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলবাসী ব্যস্ত হয়ে পড়ে অগ্রহায়ণ-পৌষমাসে ইরি-বোরো ধান চাষাবাদের জন্য। শুরু হয় বীজতলা তৈরী ও চারা রোপনের কাজ। ফাল্গুন চৈত্র-মাসে ইরি বোরো ধান কেটে ঘরে তোলা হয়। চলনবিলের নীচু জমিতে এক ফসলের বেশী অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়না। তার একমাত্র এবং প্রধান কারণ বর্ষার পানি। একই সঙ্গে উচু জমিগুলোতে নানা রকম রবি শস্যে আবাদ হয়। ফলে সেই সময়ে চলনবিলের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর সবাই কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে চলনবিলবাসীর কোন কাজ থাকে না। ঘরে বসে তাদের অলস সময় কাটাতে হয়। বাড়ী-বাড়ী তাস,ক্যারম খেলে, রেডিও,টিভি নিয়ে তাদের সময় কাটে। এ ছাড়া ভলিবল,ফুটবল খেলা নিয়ে মেতে ওঠে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বর্ষা মৌসুমে তাদের নৌকার যোগাযোগ ভালো হওয়ায় বিয়ে-অনুষ্ঠান সভাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আগে পাল তোলা অথবা বৈঠা-লগি দিয়ে নৌকা চালানো হতো,গুণ টানা হতো। এখন দিন বদলে গেছে এখন নৌকা চালানো হয় শ্যালো ইঞ্জিনের মাধ্যমে। এতে নৌকা অনেক বেশী দ্রুত গতিতে চলে। ফলে বর্ষা মৌসুমেই চলনবিলের লোকজন শুস্ক মৌসুমের চেয়ে চলাচলে সহজবোধ করে। হাতে কাজ না থাকায় এ সময় আত্নীয় কুটুমরা নৌকায় চড়ে বেড়াতে যায়। বর্ষা মৌসুমে চলনবিল অঞ্চলে উৎসব আমেজ বিরাজ করে। বিশাল আয়োজনে নবান্নের উৎসব হয়। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য যাত্রা, নাটক,জারি,সারি,পালাগান,পুঁথিপাঠ। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে দিনমজুর ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা দুঃখ কষ্টের মধ্যেই সময় কাটায়। হাতে কাজ না থাকায় তাদের সংসারে নামে অভাবের যাতনা। অনেকে কাজের সন্ধানে বাড়ীঘর ছেড়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে ভীড় জমায়। শুস্ক মৌসুমে আবার ফিরে আসে গ্রামে। এভাবেই হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ,আনন্দ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কেটে যায় এ জনপদের মানুষের যাপিত জীবন।

ঝুলে আছে চলনবিল প্রকল্প
বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানে অসম্মতি জানানোর কারণে বৃহত্তর চলনবিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুত্র থেকে জানা যায়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিলের অর্থ সহায়তায় পাবনা,নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক চলনবিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও পানি নিস্কাশনের জন্য পানি উননয়ন বোর্ড ১৯৭৭ সালে চলনবিল প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির অনেক মালিক এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ টাকা পায়নি। নির্বাহী প্রকৌশলীর মতে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জমির দাম পরিশোধ করতে বিলম্ব হচ্ছে। ১৯৯১ সালে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বৃহত্তর চলনবিল প্রকল্পের মূল্যায়ন সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকল্পটি পূনর্বাসনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে কোন দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় তা সমাপ্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়। ঐ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন কাজ শেষ করতে প্রায় ২’শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখনও কোন দাতা সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদানে রাজি না হওয়ায় চলতি বছরেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু না হবার আশংকা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এফসিডি-৩ প্রকল্পের উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে চলনবিল প্রকল্পের প্রাথমিক পুণর্বাসন কাজ শুরু হতে পারে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই বিশাল প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না বলে বিশ্ব ব্যাংক দাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার পরামর্শ দিয়েছে। চলনবিল পুনর্বাসন প্রকল্পে ৪২৬ কিলোমিটার বাঁধ,৫৭ কিলোমিটার খাল, ১৬ টি রেগুলেটর, ৫৭ টি ফ্লাসিং ইনলেট, ১৭১ কিলোমিটার সড়ক, ৪ টি ব্রিজ, ৪৭ টি কালভার্ট নির্মানের পরিকল্পনা আছে। প্রকল্পটির কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ না হওয়ায় প্রকল্প এলাকার লোকজন এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে অনেক স্থানে তীব্র পানির স্রোতের কারণে অনেক বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ফসল ও সম্পদের ক্ষতি হয়। আবার অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে এক পাশের লোক সুবিধা পেলেও ক্ষতিগ্রস্থ হয় অন্য পাশের মানুষ। বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। নির্বাহী প্রকŠশলী বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতি বছর অতি বন্যায়  জলাবদ্ধতায় দেশের খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত বৃহত্তর চলনবিল এলাকার মানুষ মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চলনবিলপাড়ের মানুষদের দাবী সত্বর চলনবিল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিলের শস্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা মজবুত করা হোক।

 

চলনবিলের সাতকাহন

 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল। এই বিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিলপাড়ের মানুষের জীবন। চলনবিলের মৎস্য সম্পদ যেমন তাদের জীবিকার অন্যতম উৎস। আবার বানের পানিতে দু’কূল ভাসানো বন্যায় এ বিলই আবার তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। পাবনা,নাটোর,সিরাজগঞ্জজেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে প্রায় ৮’শ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে চলনবিল অবস্থিত। বিলের পানি চলমান বলেই এই বিলের নামকরণ হয়েছে চলনবিল। যদিও কথিত আছে চলন দেবী নামে এক সুন্দরী মহিলা ছিল এই এলাকায়। তিনি তার দুই সন্তান নন্দ আর কুশাকে নিয়ে নৌকায় বিল পাড়ি দিচ্ছিল কিন্তু ঢেউয়ের তোরে ডুবে যায় নৌকা। মৃত্যু হয় চলনদেবী আর তার দুই সন্তানের। সেই থেকে এই বিলের নাম চলনবিল। বাংলাদেশে চলনবিলের মতো এতবড় আয়তনের আর কোন বিল নেই। অতীতে এ বিল অনেক গভীর ও বিপদসঙ্কুল ছিল। পানি আর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলের মানুষকে টিকে থাকতে হতো। ক্রমে ক্রমে পলি জমে বিলটি ভরাট হয়ে পড়েছে এবং বহু গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড়াল,আত্রাই, নন্দকুজা, গুমানী, করতোয়া, ভদ্রাবতী,বেশানী,গুড় প্রভৃতি নদী চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। চলনবিলের নামকরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা যায়নি। তবে দুই হাজার বছর আগেও চলনবিলে জলময় কোন উঁচু ভূ-ভাগ ছিল না। তখন চলনবিল মুলতঃ সমুদ্রেরই অংশ ছিল। খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের কোন কোন অংশে পানি জমে ভূমি জেগে ওঠায় সেখানে কিছু কিছু লোক বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে সমুদ্র দূরে সরে পড়ায় চলনবিল অঞ্চল জন্ম লাভ করে। বিখ্যাত চায়নিজ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায়,সপ্তম শতাব্দীতে চলনবিল অঞ্চল পদ্মা ও যমুনা নদী গর্ভে ছিল। কারণ তিনি তৎকালীন পুন্ড্রবর্ধন (বগুড়া মহাস্থানগড়) থেকে বিরাট নদী অতিক্রম করে আমামের কামরুপে (কামরুপ কামাক্ষা) পৌঁছে ছিলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে টলেমির বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যা ম্যাপ অনুযায়ী উত্তরে মহাস্থানগড়,দক্ষিণ-পূর্বে বিক্রমপুর (ঢাকা) আর চট্রগ্রাম দেখা যায়। পদ্মা ও ব্রক্ষপুত্র নদীর মধ্যবর্তী কোন স্থান দেখা যায় না। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় চলনবিল অঞ্চল তৎকালীন গঙ্গা  ব্রক্ষপুত্রের অংশ ছিল। ক্রমে পলি জমে এই বিশাল বিল এলাকা জেগে ওঠে। শুরু হয় নতুন নতুন গ্রাম ও জনপদের গড়ে ওঠা। মাত্র ১’শ বছর আগেও চলনবিলের জলময় অংশের সীমা ছিল ৫’শ মাইলের উপরে। ধীরে ধীরে পদ্মা,আত্রাই ও যমুনার নদীগুলোতে পলি জমি এর আয়তন কমতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ভূমি এবং জনবসতি। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়,চলনবিলের রাজশাহী অঞ্চলের আয়তন ছিল ২’শ ১০ বর্গমাইল এবং পাবনা অংশের আয়তন ছিল ৩’শ ৪০ বর্গমাইল। অর্থাৎ বৃহত্তর চলনবিলের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল। প্রাচীনকালে চলনবিল অঞ্চলে কলেরা ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব বেশী ছিল। কলেরায় গ্রামের পর গ্রামের লোকজন মরে বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছে। আবার ম্যালেরিয়ার কারণে চলনবিল এলাকার মানুষ ছিল শীর্ণকায় ও পেটমোটা। যোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। বিলের উন্মাতাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার প্রয়োজনে গড়ে তুলেছে নতুন নতুন জনপদ। এর ওপরে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে  ১৮৯৭ সালের ১২ জুন চলনবিল অঞ্চলের উপর প্রচন্ড ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভুমিকম্পের ফলে বহু স্থানে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। এর ফলে চলনবিলের কোন কোন নিম্নাঞ্চল উুঁচু হয়ে ওঠে আবার অনেক উুঁচু স্থান নিম্ন জলাভূমিতে পরিনত হয়। এ অবস্থাতেও চলনবিলে ৫/১০ হাত পর্যন্ত পানি থাকতো। বারো মাসই চলনবিলে বিভিন্ন পাল তোলা নৌকা চলতো। কিন্তু চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর কারণে প্রতি বছর পলি জমি  বিল ভরাট হয়ে উঠতে থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি বছর ২২২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করে। অপরদিকে ৫৩ ঘনফুট পলি নদীপথে বিলের সীমা ত্যাগ করে। অবশিষ্ট ১৬৯.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রতিবছর বিলে স্থিতি পায়। এ পলি জমে প্রতিবছর চলনবিল অঞ্চলের ভূমি ০.৫ ইঞ্চি পরিমাণ উুঁচু হয়। ১৯০৯ সালের চলনবিলের তদন্তকারী কমিটির বিবরণ থেকে জানা যায়,তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারাবছর পানি থাকতো। বর্তমানে সারাবছর পানি জমে থাকে এমন স্থান ২০ বর্গমাইলের অধিক হবে না। বিলের অধিকাংশ এলাকা আবাদযোগ্য জমিতে পরিনত হয়েছে। এসব জমিতে ধান,গম,সরিষাসহ নানা প্রকার ফসল উৎপাদিত হচ্ছে।

 

চলনবিলের প্রাচীন অবস্থান 

প্রাচীনকালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকুমার তিন চতুর্থাংশ,নওগা মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা এবং পাবনা জেলার চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া,ফরিদপুর ও বেড়া থানা এলাকা জুড়ে চলনবিল বিস্তৃত ছিল। এছাড়া বগুড়া জেলার দক্ষিণাংশের কিছু এলাকা চলনবিলের অংশ ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু বিল ভরাটের কারণে প্রতিনিয়ত কমে যায় চলনবিলের আয়তন। পরিবর্তন ঘটে এর মানচিত্রের।

 

চলনবিলের হালের অবন্থান

বর্তমানে পাবনা জেলার চাটমোহর,ফরিদপুর,বেড়া উপজেলা । নাটোর জেলার সিংড়া,বড়াইগ্রাম,গুরুদাপুর উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ,রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া  উপজেলারঅংশ বিশেষ নিয়ে চলনবিল অবস্থিত।

সিমা- চলনবিলের উত্তরে বগুড়া,দক্ষিণে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলা পূর্বে সিংড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন। পশ্চিমে নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা অবস্থিত।

ভৌগলিক অবস্থান- চলনবিল বিষুব রেখার ২৪০৭ থেকে ২৪০৩৫ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০১০ থেকে ৮৯০৩৫ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। চলনবিলের আয়তন প্রায় ৮’শ বর্গমাইল।

 

অতীতে চলনবিল

আগে চলনবিল এলাকার অধিবাসীদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বসবাস করতে হতো। লোকালয় ছিল অনেক দুরে দুরে। চারদিকে পানি বেষ্ঠিত অবস্থায় দ্বীপের মতো গ্রামগুলোকে সারা বছর প্রাকৃতিক ঝড়,বন্যা মোকাবেলা করে বাঁচতে হতো। ১২ মাসই তাদের নৌকা করে চলাচল করতে হতো। বর্ষাকালে চলনবিলের গভীরতা আরও বেড়ে যেতো। নৌপথে বিল পাড়ি দিতে গিয়ে ঢেউয়ের কবলে পড়ে অনেক স্থানে নৌকাডুবি ঘটতো। মারা যেতো বহু মানুষ। তাছাড়া দস্যু ডাকাত দলের ভয়তো ছিলই। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সওদাগরদের সহায় সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতো ডাকাত দল। মাছে ভরপুর চলনবিলে আবাদযোগ্য জমির অভাব ছিল। কিছু জমিতে চাষাবাদ হলেও বন্যা ও ঢেউয়ের আঘাতে ফসলহানি ঘটতো। যার ফলে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেই চলনবিল পাড়ের মানুষদের টিকে থাকতে হতো। এখানে ডাঙ্গায় বাঘ,বণ্য শুকর,জংলি মহিষ,বিষাক্ত সাপ এবং পানিতে কুমির.বাইসাল প্রভৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলনবিলবাসীদের বেঁচে থাকতে হতো। চলনবিলের বিস্তীর্ণ উঁচু ভূমিতে ফাকা পড়ে থাকতো অনেক জমি। এসব উঁচু ভূমি মুলতঃ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এ সময় এ সমস্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জন্য তৎকালীন রাজা জমিদাররা অন্য অঞ্চল থেকে লোকজন এনে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। জঙ্গল কেটে স্থাপন করা হয় নতুন নতুন বসতি। ফলে জঙ্গলের পাশে বসতিতে মশার কামড়ে মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। এ কারণে তখন চলনবিলের মানুষ শীর্ণকায় ও পেটমোটা ছিল। বর্ষা মৌসুমে বিলের পানি বাড়ার সাথে সাথে উঁচু ভুমি কমে আসতো তখন বাঘ,সাপ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী লোকালয়ে এসে আশ্রয় নিতো। ফলে প্রতি বছর সাপের কামড়ে এ এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের মৃত্যু ঘটতো। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ও স্বাস্থ্য সচেতন না হওয়ায় কলেরা ও ডায়রিয়ায় হাজার হাজার মনুষের মৃত্যু হতো। তারপরও সোনা ফলা চলনবিলের মাটিতে ফসল হতো ভালো। তাছাড়া প্রতি বছর পলি জমে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়তো। প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো চলনবিলে। বড় বড়  চলনবিলের শামুক ও ঝিনুক থেকে সংগ্রহ করা হতো বড় বড় মুক্তা। চলনবিলে ১২ মাস পানি থাকায় গড়ে ওঠেনি তেমন কোন সড়কপথ। ফলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কিছু কিছু হাট-বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

 

আজকের চলনবিল

পাকিস্তান শাসন আমল থেকে চলনবিল অঞ্চলে সীমিত আকারে রাস্তাঘাট নির্মাণশুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর এ অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন জোরদার হয়। নতুন নতুন স্কুল কলেজ স্থাপিত হয়। শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ,রাস্তা-ঘাট,ব্রিজ,কালভার্ট প্রভৃতি নির্মাণের মাধ্যমে মাধ্যমে চলনবিল অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতে শুরু করে। প্রতিটি উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ সম্পন্ন হয়েছে। চলনবিলের বুক চিরে সড়ক নির্মিত হওয়ায় অনেক অঞ্চলে বাস চলাচল করছে। অনেক দূর্গম এলাকায় বিদ্যুত সুবিধা পৌছে গেছে। ১৯৭৭ সালে চলনবিল অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৮ হাজা টাকা ব্যয়ে ২৫১ মাইল দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, ১৮৭ মাইল পানি নিস্কাশন খাল, ২৪ টি রেগুলেটর, ৫৮ টি ফ্লাসিং আউটলেট ও ইনলেট,৫৫ টি ব্রিজ,কালভার্ট, ১৩২ টি ভবন নির্মাণ এবং ৯ হাজার ২’শ একর জমি হুকুম দখল করা হয়। প্রকৌশলীরা আশা করেছিলেন এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ হাজার একর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে মাত্র ৫০ ভাগ কাজ শেষ করে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অপরিকল্পিতভাবে কিছু অংশে বাঁধ ও রেগুলেটর নির্মিত হলেও চলনবিলবাসী এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। প্রতি বছর বন্যার বাঁধ ভেঙ্গে হাজার হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে যায়। অপরদিকে একই বাঁধের এক অংশের লোক বন্যা নিয়ন্ত্রণ সুবিধা পেলেও অন্য অংশের ফসল ডুবে যায়। এ কারণে চলনবিলবাসী প্রতিনিয়ত দূর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০০১ সালে চলনবিলের বুক চিরে দীর্ঘ ৫৫ কিলোমিটার হাটিকুমরুল-বনপাড়া সড়ক নির্মিত হয়। ফলে ঢাকার সংগে বিলপাড়ের মানুষদের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। সড়কের কারণে চলনবিলের কৃষকরা সহজেই তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ এবং উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছে। তা সত্ত্বেও চলনবিলের সিংহ ভাগ এলাকা এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ সমস্ত এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বিদ্যুত সুবিধা আজও পৌছেনি। তার উপর প্রতি বছর অতিবর্ষণ,শিলাবৃষ্টির কারণে চলনবিলবাসী কমবেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। চলনবিল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চলনবিলবাসীকে অতিবর্ষণ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যেতো।

 

চলনবিলে প্রকৃতির খেয়াল

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে খরা ও বন্যার কারণে সৃষ্ট দূর্ভিক্ষ চলনবিলবাসীকে আঘাত হানে। সে বছর চলনবিল এলাকায় ফসল উৎপাদিত হয়নি। ফলে এ অঞ্চলের মানুষদের দূর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৮৮ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় চলনবিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে বছর চলনবিলে তিন-চতুর্থাংশ বাড়ী ঘরে বানের পানি ঢুকে পড়ে। হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে পড়ে। এ অঞ্চলে রোপা ও বোনা আমন ধান তলিয়ে যায়। ১৯৯১ সালে প্রচন্ড শিলাবৃষ্টিতে চলনবিল এলাকার হাজার হাজার একর উঠতি ইরি বোরো ধান ঝরে পড়ে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় রোপা ও বোনা আমন ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সর্বশেষ ২০০৩ সালে সালে বন্যায় চাটমোহর,তাড়াশ,সিংড়া,রায়গঞ্জ এবং উল্লাপাড়া উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলের মানুষ প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে চলনবিলের অনেক উর্বর মাটি থাকা সত্ত্বেও বন্যা,ঝড়,শিলাবৃষ্টির কাছে বারংবার হাড় মানতে হয় চলনবিলপাড়ের মানুষদের। সহায় সম্বল হারিয়ে অনেকেই হয়ে পড়ে নিঃস্ব-রিক্ত।

 

চলনবিলের শস্য সম্পদ

প্রাকৃতিকভাবেই চলনবিলের মাটি ভীষণ উর্বর। তার উপর প্রতি বছর পলি জমে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ফলে চলনবিল অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। সেই কারণেই উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার বলা হয় চলনবিলকে। বর্ষার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে চলনবিলের নিম্নাঞ্চলে দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষ শুরু হয়। মাটির উর্বরা শক্তির কারণে একবিঘা জমিতে ২০ থেকে ৩৫ মণ পর্যন্ত ইরি ধান উৎপাদিত হয়। পানির কারণে অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা যায়না। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে প্রচুর পরিমাণে গম,সরিষা, তিল,রসুন, আদা, পেয়াজ,ভট্টাসহ নানাবিধ ফসল উৎপদিত হচ্ছে। কয়েক বছর যাবত গুরুদাসপুর,বড়াইগ্রাম ও চাটমোহরে (আংশিক) বিপুল পরিমাণ রসুন উৎপাদিত হচ্ছে।

 

চলনবিলের মৎস্য ভান্ডার

চলনবিলে রয়েছে এক বিশাল মাছের ভান্ডার। চলনবিলের মাছের কদর দেশ জুড়ে রয়েছে।  চলনবিলের বিস্তীর্ণ হাওড়, খাল, বিল, নদীনালায় ইলিশ, কৈ, মাগুর, শিং, টাকি, বোয়াল, শোল, চিতল, ফলই,রুই,মৃগেল,চিংড়ি,টেংরা,মৌসি,কালিবাউশ, রিটা, গজার, নান্দিনা, শৌল, মধু পাপদা, রানী চিতল, বাইন, চেলা,বাতাসী, বাঁশপাতা, ঘৈরা, ফাঁসী, মোয়া, মৌমি, রায়েক, এলং, ঘাইরা, চান্দা, নোদাই, দাঁইত পুটি, বৌ,সরপুটি, তিতপুটি,পুঁটি, গুজা,গাগর,বাঘাইর কাঁটা প্রভৃতি জাতের বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয় চলনবিলে। প্রতিবছর বর্ষার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে চলনবিলপাড়ের শত শত মানুষ চলনবিলের মিঠা পানির মাছ শিকার করে। অনেকেই জাল,বড়শি ও বাঁশের তৈরী নানারকম মাছ ধরার ফাঁদ বানায়। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র  জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ মাছ মেরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। চলনবিলের মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। মাছের সিজনে তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বিশ্বরোডে প্রতিদিন মাছের হাট বসে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি হয় এই হাটে। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় এই মাছের হাট। ট্রাকে করে মাছ চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চলনবিলের এ সকল মাছের মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

চলনবিলের পাখি

চলনবিলের বালিহাঁস, তিরমূল, বাটুলে, মুরগীহাঁস, খয়রা, মানিক জোড়, ডুটরা, চা-পাখি, লোহাড়াং, মেমারু, বোতক, নলকাক, ফেফী, ডাইক, চখা, বকধেনু, ইচাবক, করা, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিল, মাছরাঙ্গা, কাউর,চাকলাসহ প্রভৃতি পাখি পাওয়া যেত। মানুষ হাত দিয়েই পাখি ধরতে পারত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নাকি শুধু পাখি শিকারের জন্য কয়েকবার এ বিলে এসেছেন। এখন সবই কল্পনার বিষয়।

 

এবং ইত্যাদি

কুমির, শুশুক, বাইসাল, সাপ, হিংস্র মহিষ, শুকর, কচছপ, ঝিনুক, শামুক,জোঁকসহ হাজারো জীব বৈচিত্রের অঞ্চল হচ্ছে চলনবিল অঞ্চল। এছাড়া নানা জাতের জলজ ফল এক সময় চলনবিলের ভান্ডার পরিপূর্ণ ছিল।   চলনবিলের পনসা ফল ছিল পাক-ভারতে বিখ্যাত। অতীতে এখানে প্রচুর পরিমাণে পদ্মচাকা,মাখনা, শিঙ্গট, নিঙ্গট,ঢ্যাপ, শালুক, সিঙ্গরার প্রভৃতি সুস্বাদু জলজ ফল জন্মাতো। এসবই এখন কেবলই অতীত।

 

চলনবিলের অধিবাসী

চলনবিল অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিরাটএকাংশ হচ্ছে আদিবাসী, জেলে, মুচি পরিবারসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি। তারা অত্যন্ত অসচেতন, নিঃশেষিত, অত্যাচারিত এবং সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে অনেকে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছে চলনবিল অঞ্চলে।

 

চলনবিলের পরিবেশ সমস্যা

চলনবিল এলাকার পানি সম্পদ, কৃষি সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও জলের অভ্যন্তরীন যে জীব বৈচিত্র সে সকল সম্পদসহ কোন সম্পদের সাথেই পরিবেশ বান্ধব আচরণ করা হচ্ছে না, ফলে চলনবিলের সার্বিক সংকট ক্রমেই জাতীয় সংকটকে স্পর্শ করছে বলে মনে করা যথেষ্ট কারণ আছে। কৃষিতেও সার, কীটনাশকসহ পরিবেশ বৈরী দ্রব্যাদি ব্যবহার হচ্ছে, ফলে কৃষিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি চলনবিলাঞ্চলে বর্তমানে আবাদ হচ্ছে তামাকের। চলনবিলের মাঝখান দিয়ে কিলোমিটার বিশ্বরোড নির্মাণ করার পর থেকে চলনবিলকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবাদী জমি ভরাট করে করে গড়ে উঠছে বসতি। তৈরী হচ্ছে মিল, কল-কারখানা, মার্কেট।

 

চলনবিলের মানুষের যাপিত জীবন

বর্ষা মৌসুমে পানি নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলবাসী ব্যস্ত হয়ে পড়ে অগ্রহায়ণ-পৌষমাসে ইরি-বোরো ধান চাষাবাদের জন্য। শুরু হয় বীজতলা তৈরী ও চারা রোপনের কাজ। ফাল্গুন চৈত্র-মাসে ইরি বোরো ধান কেটে ঘরে তোলা হয়। চলনবিলের নীচু জমিতে এক ফসলের বেশী অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়না। তার একমাত্র এবং প্রধান কারণ বর্ষার পানি। একই সঙ্গে উচু জমিগুলোতে নানা রকম রবি শস্যে আবাদ হয়। ফলে সেই সময়ে চলনবিলের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর সবাই কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে চলনবিলবাসীর কোন কাজ থাকে না। ঘরে বসে তাদের অলস সময় কাটাতে হয়। বাড়ী-বাড়ী তাস,ক্যারম খেলে, রেডিও,টিভি নিয়ে তাদের সময় কাটে। এ ছাড়া ভলিবল,ফুটবল খেলা নিয়ে মেতে ওঠে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বর্ষা মৌসুমে তাদের নৌকার যোগাযোগ ভালো হওয়ায় বিয়ে-অনুষ্ঠান সভাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আগে পাল তোলা অথবা বৈঠা-লগি দিয়ে নৌকা চালানো হতো,গুণ টানা হতো। এখন দিন বদলে গেছে এখন নৌকা চালানো হয় শ্যালো ইঞ্জিনের মাধ্যমে। এতে নৌকা অনেক বেশী দ্রুত গতিতে চলে। ফলে বর্ষা মৌসুমেই চলনবিলের লোকজন শুস্ক মৌসুমের চেয়ে চলাচলে সহজবোধ করে। হাতে কাজ না থাকায় এ সময় আত্নীয় কুটুমরা নৌকায় চড়ে বেড়াতে যায়। বর্ষা মৌসুমে চলনবিল অঞ্চলে উৎসব আমেজ বিরাজ করে। বিশাল আয়োজনে নবান্নের উৎসব হয়। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য যাত্রা, নাটক,জারি,সারি,পালাগান,পুঁথিপাঠ। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে দিনমজুর ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা দুঃখ কষ্টের মধ্যেই সময় কাটায়। হাতে কাজ না থাকায় তাদের সংসারে নামে অভাবের যাতনা। অনেকে কাজের সন্ধানে বাড়ীঘর ছেড়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে ভীড় জমায়। শুস্ক মৌসুমে আবার ফিরে আসে গ্রামে। এভাবেই হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ,আনন্দ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কেটে যায় এ জনপদের মানুষের যাপিত জীবন।

 

ঝুলে আছে চলনবিল প্রকল্প

বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানে অসম্মতি জানানোর কারণে বৃহত্তর চলনবিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুত্র থেকে জানা যায়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিলের অর্থ সহায়তায় পাবনা,নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক চলনবিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও পানি নিস্কাশনের জন্য পানি উননয়ন বোর্ড ১৯৭৭ সালে চলনবিল প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির অনেক মালিক এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ টাকা পায়নি। নির্বাহী প্রকৌশলীর মতে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জমির দাম পরিশোধ করতে বিলম্ব হচ্ছে। ১৯৯১ সালে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বৃহত্তর চলনবিল প্রকল্পের মূল্যায়ন সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকল্পটি পূনর্বাসনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে কোন দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় তা সমাপ্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়। ঐ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন কাজ শেষ করতে প্রায় ২’শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখনও কোন দাতা সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদানে রাজি না হওয়ায় চলতি বছরেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু না হবার আশংকা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এফসিডি-৩ প্রকল্পের উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে চলনবিল প্রকল্পের প্রাথমিক পুণর্বাসন কাজ শুরু হতে পারে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই বিশাল প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না বলে বিশ্ব ব্যাংক দাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার পরামর্শ দিয়েছে। চলনবিল পুনর্বাসন প্রকল্পে ৪২৬ কিলোমিটার বাঁধ,৫৭ কিলোমিটার খাল, ১৬ টি রেগুলেটর, ৫৭ টি ফ্লাসিং ইনলেট, ১৭১ কিলোমিটার সড়ক, ৪ টি ব্রিজ, ৪৭ টি কালভার্ট নির্মানের পরিকল্পনা আছে। প্রকল্পটির কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ না হওয়ায় প্রকল্প এলাকার লোকজন এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে অনেক স্থানে তীব্র পানির স্রোতের কারণে অনেক বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ফসল ও সম্পদের ক্ষতি হয়। আবার অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে এক পাশের লোক সুবিধা পেলেও ক্ষতিগ্রস্থ হয় অন্য পাশের মানুষ। বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। নির্বাহী প্রকŠশলী বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতি বছর অতি বন্যায়  জলাবদ্ধতায় দেশের খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত বৃহত্তর চলনবিল এলাকার মানুষ মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চলনবিলপাড়ের মানুষদের দাবী সত্বর চলনবিল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিলের শস্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা মজবুত করা হোক।